আইডিয়া প্রকাশনে স্বাগতম!
ড্রপডাউন মেনু
| | ০ মন্তব্য

মারুফ হোসেন মাহবুব

একজন লেখকের প্রথম সফলতা হলো পাঠকের কাছ থেকে সময় আদায় করে নেয়া। নিজের লেখার জালে পাঠককে আটকে ফেলা। লেখা পড়া শুরু করলে লেখার সাথে পাঠক এমনভাবে সম্পৃক্ত হবেন যেমন করে পিঁপড়া গুড় পেলে মত্ত হয়ে যায় গুড় সাবাড়ে, যেমন করে পাকা পেঁপে পেলে হলুদ পাখিটি সাবাড় করে নিবিষ্ট মনে সারাটা নির্জন অপরাহ্ন।

হুমায়ুন আহমেদের লেখার উদাহরণ এই ক্ষেত্রে মোক্ষম। তাঁর লেখা এমনভাবে শুরু হয়- পাঠক যেন তীব্র শীতে আবেশী উষ্ণ এক পরিমন্ডলে প্রবেশ করে, পাঠক যেন প্রচন্ড দাবদাহে শীতল কুলুঙ্গির এক গেলাস পানি পান করে তৃষ্ণা মেটায়, পাঠক যেন পরম কাঙ্খিত বৃষ্টিতে ভিজেভিজে প্রিয় পথ ও জগতে পরিভ্রমন করে।
কথাগুলো ভাবনায় এসেছে ভাস্কর অনীক রেজার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘#নির্জন_হাত’ পাঠের পর।
গত ঈদের ছুটির শুরুর দুই-তিনদিন টানা পাঠ করেছি অনিক রেজার দশটি অসাধারণ, অনন্য ও প্রাঞ্জল গল্পে সাজানো বই ‘নির্জন হাত’।
লেখক হিসেবে এবং মানুষ হিসেবে এক অসাধারণ চরিত্র অনীক রেজা। যেমন করে অনিক রেজা তাঁর প্রতিটি ভাস্কর্য আর শিল্পকর্ম নির্মাণ করেন সুড়কী, মসলা, আর নানা ধাতব-অধাতব বস্তুতে, তেমনি খোদাই করার মত প্রতিটি অক্ষর নিপুনভাবে তিনি বসিয়ে বসিয়ে নির্মাণ করেছেন তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ ও শিল্পমানসকল্প এক একটি গল্প।
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের পিতার স্বপ্ন ছিলো সৈয়দ শামসুল হক ডাক্তার হবেন। কলকাতায় ডাক্তারি পড়াকালীন তিনি তাঁর এক ডাক্তারি বিদ্যার ইংরেজ শিক্ষকের কাছে শোনা উপদেশ সৈয়দ হককে শোনাতেন। পরবর্তীতে লেখক তাঁর স্মৃতিকথায় সে বিষয়ে লিখেছেন ‘কথাটি পরবর্তীকালে বালক আমাকে বহুবার তিনি বলেছেন এবং তার প্রতিষ্ঠিত হোমিও রইসি মেডিকেল কলেজের ছাত্রদেরও তিনি বলতেন; সেই কথাটিকে আমি আমার লেখক জীবনের বীজমন্ত্র হিসেবে আজো দেখি। ইংরেজ সেই শিক্ষকটি বলেছিলেন: ভালো ডাক্তার হতে হলে চাই তিনটি গুণ- সিংহের হৃদয়, ঈগল পাখির চোখ এবং নারীর হাত। আজ আমি যখনি কলম ধরি, স্মরণ করি কথাগুলো। একজন লেখকেরও হৃদয় হবে সিংহের মতো, হবে সে অকুতোভয়; চোখ ঈগল পাখির মতো, কোনো কিছুই দৃষ্টি এড়াবে না তার; হাত হবে নারীর মতো মমতায়, জননীর মতো কল্যাণমাখা। বলতে পারি ওই তিন থেকে আমি সজ্ঞানে কখনো সরে আসিনি।’
অনীক রেজার লেখা পড়ার পর আমার সৈয়দ শামসুল হকের এই স্মৃতিচারণার অনুসঙ্গটি বারবার মনে পড়েছে। প্রচলিত সমাজে বিশেষ করে বাংলাদেশের সামাজিক প্রক্ষাপটে তিনি সিংহহৃদয়ের মত সাহসী ও দ্বিধাহীনচিত্তের পরিচয় দিয়েছেন। লেখকের হৃদয় আর হাত যখন কুন্ঠায় আর শংকা-ভয়ে কম্পিত হবে না তখনই লেখক হবেন অনন্য এক সত্তা।
নির্জন হাত গল্পগ্রন্থের গল্পের প্লট সাজাতে লেখক দৃশ্যপট এমনভাবে খোলামেলা কথামালায় অথচ চুম্বকের মতো আকর্ষণীয় করে সাজিয়েছেন যে স্বাতন্ত্রতা সহসা সব লেখকের মধ্যে দৃশ্যমান হয় না। মদ, নেশা, সানিলিয়ন, ডাক্তার প্রেমিক বরের বাসররাতে সতীচ্ছদা পরীক্ষা, কৈশোরের রক্তেলেখা চিঠির প্রেম, করোনা রোগীর সেবাদাত্রী একজন নার্স করোনা আক্রান্ত হলে সবার দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে হাসপাতালে তার বিভীষিকাময় নির্জন কক্ষের অসহায়ত্ব ও একজন একলা প্রবীণ লেখকের সেই সেবিকার সাথে জড়িয়ে পড়া- এমনি সব অকল্পনীয় অথচ সমাজের স্রোতে পানার মত অহরহ ভাসমান গল্পের টুকরোটুকরো দৃশ্য শিল্পীর নিপুন হাতে সাজিয়েছেন গল্পকার, ভাস্কর অনীক রেজা।
তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ কমলা রঙের রোদ’ ও এক সরেস, অনন্য সাহিত্য সৃষ্টি।
লেখক তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থের নাম দিয়েছেন ‘কমলা রঙের রোদ’ আর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থের নাম ‘নির্জন হাত’।
জীবনরহস্য আচ্ছাদিত কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এই শব্দগুচ্ছের দেখা মেলে। জীবনের বিবিধ রহস্যাদীর শৈল্পিক উন্মোচন ঘটিয়েছেন ভাস্কর অনিক রেজা তাঁর প্রতিটি গল্পে।
রংপুরের আইডিয়া প্রকাশন থেকে গত দুইবছরের বইমেলায় প্রকাশিত বই দু’টি ইতোমধ্যেই প্রতিটি পাঠক কর্তৃক নন্দিত হয়েছে।
লেখককে অভিবাদন।

মারুফ হোসেন মাহবুব
কবি ও শিক্ষক

বিভাগ: গ্রন্থালোচনা

Leave a Reply